ভালবাসা ছাড়া জীবন শূন্য,তাই ভালবাসা দিয়ে জয় করতে চাই এই ভুবন।

বুধবার, ২১ মার্চ, ২০১৮

হারিয়ে ফেলা ভালবাসা!!

গ্রামের একটি স্কুল, প্রায় ১৩০০ এর বেশি ছাত্র-ছাত্রী । আসে-পাশের পাঁচ গ্রাম মিলে এই একটাই প্রাইমারি স্কুল । তাই শিক্ষার্থীর সংখ্যা তুলনামূলক বেশি । স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর একজন মেধাবী এবং ভদ্র ছাত্র কৌশিক । স্কুলের সব সকল শিক্ষক-শিক্ষিকারা কৌশিককে খুব আদর-স্নেহ করন । শৈশবের দুরন্তপনা কৌশিকের সব খানে । নতুন শ্রেণীতে কিছু নতুন মুখ কৌশিক আবিষ্কার করল । চঞ্চলতার মাঝেও কৌশিকের একটি অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য ছিল । সে সহজে কারও সাথে সহজে মিশতে পার না, লজ্জাবোধ করত ।
নতুন শিক্ষার্থীদের মধ্যে হাফসা অন্যরকম । সে চুপচাপ থাকত । তাকিয়ে শুধু সব দেখত । পড়াশুনা ছাড়া কিছুই বুঝতনা । তাই কৌশিকের হাফসার প্রতি বিশেষ আকর্ষণ তৈরী হয় । কৌশিকের ভয়, যদি এবার হাফসা তার প্লেসটি দখল করে তাহলে স্কুলে তার আদর কমে যাবে । তাছাড়া একটা মেয়ে হয়ে তাকে পিছনে ফেলবে তা কখনোই মেনে নেওয়া যায় না ।
কৌশিক হাফসার সাথে কথা বলার সুযোগ খুঁজতে থাকে কিন্তু শুধু ভয় হয় তার, যদি হাফসা কিছু মনে করে । একদিন টিফিনের সময় কৌশিক হাফসা কাঁপা স্বরে জিজ্ঞেস করেই ফেলে, “কেমন আছ হাফসা?” হাফসা একটু মুচকি হেসে বলে, “হ্যা ভাল” । হাফসা প্রতুত্তরে কিছুই বলার প্রয়োজন বোধ করল না । ঐদিন তেমন আর কোন কথাই হলো না তাদের । এই দিনের পর থেকে তারা মাঝে মাঝে একজন অন্যজনে দিকে তাকিয়ে ‍থাকত । মনে হতো যেন তারা মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে । চোখে চোখেই তাদের কথা হয়েযেত, ঝগড়া হয়েযেত! মাঝে মাঝে অভি মুখ ঙেংচে দিত । অভি খুব শান্ত স্বভাবের মেয়ে । হৈ হুল্লা তেমন পছন্দ করতো না, এসবে যেতো না । খুব সুন্দর ছবি আঁকতে পারত অভি । সে সব সময় খাতার উপরের পৃষ্ঠায় কার্টুন এঁকে রাখত । হাফসার চোখগুলো খুব সুন্দর, চেহারার রং উজ্জ্বল নয় তবে মার্ধুযতা ছিল । দেখলে মনে হতো চেহারায় যাদু আছে। চুলগুলো ছিল কাধ পর্যন্ত । অনেক দূর থেকেও চিনতে কষ্ট হতো না কৌশিকের । অভির বাবা এগ্রামেই একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করেন। সেই সূত্রে হাফসার এস্কুলে ভর্তি হওয়া ।

এভাবেই পড়াশুনা আর দুষ্টুমিতে দেখতে দেখতে ৫/৬ মাস কেটে গেল । নতুন সব শিক্ষার্থীদের সাথে কৌশিকের ভাল বন্ধুত্ব তৈরী হয়েগেল । নতুন-পুরাতন সব বন্ধুদের সাথে টিফিনের সময় মাঝে মাঝে কৌশিক ঘুরতে বের হতো, খেলাধুলা করতো, বর্ষায় কাগজের নৌকা বানিয়ে পানিতে ভাসাতো, গাছ থেকে কাঁচা আম পেড়ে বন্ধুরা মিলে খায় আরও কত্ত কি করতো ! কিন্তু এসবের মাঝে কৌশিক অভিকে খুব মিস করতো! খুব জেদ হতো অভির প্রতি! কৌশিক জানতো, অভিকে এসব নিয়ে কিছু বললেই সে বলবে, “এসব আমার ভাল লাগেনা”। কৌশিকের কাছে মেয়েটাকে প্রতিবন্ধি টাইপের মনে হতো । তাই সে অভিকে মাঝে মাঝে প্রতিবন্ধি বলে ডাকতো ।
আরও কয়েক মাস পর বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার দিন চলেএসেছে। বার্ষিক পরীক্ষার পর বাড়িতে ১৫ দিন সময় বন্ধুদের ছেড়ে থাকতে কৌশিকের খুব কষ্ট হচ্ছে । বিশেষ করে প্রতিবন্ধি হাফসা-টার জন্য । কিন্তু কিছুই করার নেই, কারণ হাফসাদের বাসা কোথায় কৌশিকের তা জানা নেই । হাফসার বাবা মটরসাইকেল দিয়ে সকালে স্কুলে দিয়ে যেত আবার বিকেলে নিয়ে যেত । তাছাড়া হাফসার বাসা সম্পর্কে জানার প্রয়োজন বোধ করেনি কৌশিক ।
কৌশিক এবারও প্রথম স্থান অধিকার করেছে । তাই মনে খুব আনন্দ । সকল বন্ধু-বান্ধব এবং শিক্ষকদের সাথে সে আনন্দ শেয়ার করল । কৌশিক এবছর পঞ্চম শ্রেণিতে উত্তির্ণ হয়েছে । সে এবছর বৃত্তি পরীক্ষা দিবে । তাই পড়াশুনায় আরও মনোযোগী হতে হবে । ফলাফল ঘোষণার দিন সবাইকে পাওয়া গেলেও হাফসাকে পাওয়া গেলনা । তাই এইদিনে কিযেন অপূর্ণতা থেকে গেল কৌশিকের ।

পঞ্চম শ্রেণির পাঠদান শুরু হয়েছে । আজ নিশ্চয়  হাফসা আসবে- কৌশিক ভাবছে । কিন্তু না আজও হাফসা আসেনি । এভাবে দিনগুনতে গুনতে সপ্তাহ কেটে গেল হাফসা কোন খোঁজ নেই । হঠাৎ একদিন কৌশিক জানতে পারে অভির বাবা এখান থেকে অন্যত্র বদলি হয়েগেছেন । তাই হাফসাকে ঐখানের একটি স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে । শুনে কৌশিক স্থির হয়েগেল । ছোট হৃদয়ে বড় কষ্ট পেল কৌশিক। এক বার বলে যেতে পারত প্রতিবন্ধিটা! আসলেই একটা প্রতিবন্ধি! তারপরও দিন-রাত মনে মনে কৌশিক ভাবত- “কেমন আছে প্রতিবন্ধিটা? সে এখন কি করছে? সে কি ভাল আছে?” ইত্যাদি ইত্যাদি ।
ক্লাসের ফাঁকে মাঝে মাঝে সে কোথায় যেন হারিয়ে যায়। হাফসা যে বেঞ্ছে বসত সেখানে তাকিয়ে থাকতো, অভির মুখ ভেংচানো দৃশ্যটা মনে পড়তো খুব । অভির স্মৃতিগুলো চার দিকে ভেসে বেড়াত । কৌশিকের ছোট্ট জীবনে আজ বিশাল শূন্যতা বিরাজ করছে । কাউকে সে বোঝাতে পারছে না । হঠাৎ এমন কোন ঘটনা তার জীবনে ঘটবে তা কৌশিক ভাবতেই পারেনি ।
আজ অনেক পছর পর ট্রেনে বসে কৌশিক এসব স্মৃতিগুলো রোমন্থন করছিল । ঢাকা থেকে সে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছে । তার শহরে একটা ভাল চাকুরি হয়েছে । মনটা একটু আগেও ভাল ছিল । কিন্তু বিমান বন্দর রেলস্টেশনে একটি ঘটনা তাকে শৈশবে ফিরিয়ে নিয়েগেল ।
কৌশিক তার কাগজপত্রগুলো দিখছিল আর ভাবছিল খুশির খবরটা সে নিজের মুখে তার বাবা-মাকে জানাবে। বিকাল ৫টায় মহানগর গোধুলিতে করে কৌশিকের বাড়ি যাওয়ার কথা। তার পাশে ছোট্ট সুন্দর ৫-৬ বছরের একটি মেযে শিশু বসা ছিল । হঠাৎ বাচ্চাটির দিকে চোখ পড়তেই বাচ্চাটিতে খুব চেনা মনে হলো কৌশিকের । পরিচিত চোখ-মুখ কোথায় যেন সে দেখেছে কিন্তু মনে পড়ছে না ! পাশের মহিলাটিই সম্ভবত বাচ্চাটির মা । কাল বোরকা পরা এবং অন্যদিকে তাকিয়ে আছে তাই কিছূই বোঝা যাচ্ছে না । পাশেই নীল রংয়ের একটি ট্রাভেল ব্যাগ । ব্যাগের ওপর কার্টুনের ছবি ।
পাশে ফিরতেই চোখে চোখ পড়ল। অপলক দৃষ্টিতে কৌশিক চোখগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে । সে ধাঁধায় পড়ে গেল! মনে মনে ভাবছে কে সে? আবার নিজেই বলছে যদি পরিচিত হয় তাহলে তো আমাকেও চিনবে, কথা বলবে! কিন্তু কিছুই বলা হয়ে উঠল না ।
একটুপর একজন লোক এসে মহিলাটির উদ্দেশ্যে বলল, “চলো হাফসা, সামনের দিকে যাই, এখনই আমাদের ট্রেন চলে আসবে”
কথাটা শুনা মাত্রই কৌশিক বসা থেকে আস্তে আস্তে দাঁড়িয়ে যায় । এখন আর কিছুই বুঝতে বাকি রইলনা কৌশিকের । এই সেই হাফসা! এত্তগুলো বছর পর! এটা হাফসা মেয়ে! আর লোকটা হাফসার স্বামী । চোখগুলো মায়ের মতোই পেয়েছে । এসব ভাবতে ভাবতে কৌশিকের মুখ দিয়ে আর কোন কথাই বের হচ্ছে না । কৌশিক কি করবে, কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না ।
হাফসা বাচ্চাকে নিয়ে প্লট ফর্মে হাটতে থাকল, সাথে স্বামী নীল রংয়ের ব্যাগটা নিয়ে । বাচ্চাটি কাধে মাথা রেখে কৌশিকের দিকে চোখ ‍নিয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আর কৌশিক তখনও অসহায় ভাবে একই স্থানে দাড়িয়ে । অল্পক্ষণের মধ্যেই হাফসারা লোকজনের ভীড়ে দৃষ্টিসীমার বাহিরে চলেগেল । সেই শান্ত প্রতিবন্ধি হাফসা-টা একবার ফিরেও তাকাল না!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন