পুন্ড্রবর্ধনের রাজধানী পুন্ড্রনগর (বর্তমান
মহাস্থান) এবং অপর শহর কোটিবর্ষ
(বর্তমান বানগড়)এর
মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত ছিল
সোমপুর মহাবিহার। এর
ধ্বংসাবশেষটি বর্তমান
বাংলাদেশের বৃহত্তর রাজশাহীর
অন্তর্গত নওগাঁ জেলার
বাদলগাছি উপজেলার পাহাড়পুর
গ্রামে অবস্থিত। অপর দিকে জয়পুরহাট
জেলার জামালগঞ্জ রেলস্টেশন
থেকে এর দূরত্ব পশ্চিমদিকে মাত্র ৫
কিমি। এর ভৌগলিক অবস্থান ২৫°০´ উত্তর
থেকে ২৫°১৫´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮°৫০
´ পূর্ব থেকে ৮৯°১০´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ
পর্যন্ত।
গ্রামের মধ্যে প্রায় ০.১০ বর্গ
কিলোমিটার (১০ হেক্টর) অঞ্চল
জুড়ে এই পুরাকীর্তিটি অবস্থিত।
প্রত্নতাত্ত্বিক এই নিদর্শনটির
ভূমি পরিকল্পনা চতুর্ভূজ আকৃতির।
এটি বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের
প্লাবন সমভূমিতে অবস্থিত,
প্লাইস্টোসীন যুগের বরেন্দ্র নামক অনুচ্চ
এলাকার অন্তর্ভুক্ত। মাটিতে লৌহজাত
পদার্থের উপস্থিতির
কারণে মাটি লালচে। অবশ্য
বর্তমানে এ মাটি অধিকাংশ
স্থানে পললের নিচে ঢাকা পড়েছে।
পার্শ্ববর্তী সমতল ভূমি থেকে প্রায়
৩০.৩০ মিটার উচুতে অবস্থিত পাহাড়
সদৃশ
স্থাপনা হিসেবে এটি টিকে রয়েছে।
স্থানীয় লোকজন একে ‘গোপাল
চিতার পাহাড়’ আখ্যায়িত করত। সেই
থেকেই এর নাম হয়েছে পাহাড়পুর,
যদিও এর প্রকৃত নাম সোমপুর বিহার।
বৌদ্ধ বিহারটির ভূমি-
পরিকল্পনা চতুষ্কোনাকার। উত্তর ও
দক্ষিণ বাহুদ্বয় প্রতিটি ২৭৩.৭
মি এবং পূর্ব ও পশ্চিম বাহুদ্বয় ২৭৪.১৫ মি।
এর চারদিক চওড়া সীমানা দেয়াল
দিয়ে ঘেরা ছিল। সীমানা দেয়াল
বরাবর অভ্যন্তর ভাগে সারিবদ্ধ ছোট
ছোট কক্ষ ছিল। উত্তর দিকের
বাহুতে ৪৫টি এবং অন্য তিন দিকের
বাহুতে রয়েছে ৪৪টি করে কক্ষ। এই
কক্ষগুলোর তিনটি মেঝে আবিষ্কৃত
হয়েছে।
প্রতিটি মেঝে বিছানো ইঁটের ওপর পুরু
সুরকী দিয়ে অত্যন্ত মজবুত
ভাবে তৈরি করা হয়েছিলো। সর্বশেষ
যুগে ৯২টি কক্ষে মেঝের ওপর বিভিন্ন
আকারের বেদী নির্মাণ করা হয়। এ
থেকে অনুমান করা যায় যে, প্রথম
যুগে সবগুলো কক্ষই ভিক্ষুদের আবাসকক্ষ
হিসেবে ব্যবহৃত হলেও
পরবর্তীকালে কিছু কক্ষ
প্রার্থনাকক্ষে রুপান্তর
করা হয়েছিলো।
কক্ষগুলোর প্রতিটিতে দরজা আছে। এই
দরজাগুলো ভেতরের দিকে প্রশস্ত কিন্তু
বাইরের দিকে সরু হয়ে গেছে। কোন
কোন কক্ষে কুলুঙ্গি পাওয়া যায়।
কুলুঙ্গি সম্বলিত কক্ষগুলোর
মেঝেতে দৈনন্দিন ব্যবহারযোগ্য বেশ
কিছু দ্রব্যাদি পাওয়া যায়। ভেতরের
দিকে কক্ষগুলোর দৈর্ঘ্য ৪.২৬
মি এবং প্রস্থ ৪.১১ মি। কক্ষের পেছনের
দিকের দেয়াল অর্থাৎ
সীমানা দেয়াল ৪.৮৭মি এবং সামনের
দেয়াল ২.৪৪মি চওড়া। কক্ষগুলোর
সামনে ২.৫মি প্রশস্ত
টানা বারান্দা আছে। ভেতরের
দিকের উন্মুক্ত চত্বরের
সাথে প্রতিটি বাহু সিঁড়ি দিয়ে যুক্ত।
বিহারের উত্তর বাহুর মাঝ বরাবর
রয়েছে প্রধান ফটক। এর বাইরের ও
ভেতরের দিকে একটি করে স্তম্ভ
সম্বলিত হলঘর এবং পাশে ছোট ছোট
কুঠুরি আছে। এই কুঠুরিগুলো বিভিন্ন
উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হত। প্রধান ফটক
এবং বিহারের উত্তর-পূর্ব কোনের
মাঝামাঝি অবস্থানে আরও
একটি ছোট প্রবেশ পথ ছিলো। এখান
থেকে ভেতরের উন্মুক্ত
চত্বরে প্রবেশের জন্য যে সিঁড়ি ব্যবহৃত
হত তা আজও বিদ্যমান। উত্তর, দক্ষিণ ও
পশ্চিম বাহুতেও অনুরুপ সিঁড়ির
ব্যবস্থা ছিলো। এদের মাঝে কেবল
পশ্চিম বাহুর সিঁড়ির চিহ্ন আছে। উত্তর
বাহুর প্রবেশ পথের সামনে ১৯৮৪ সাল
পর্যন্ত একটি পুকুর ছিল। ১৯৮৪-৮৫ সালের
খননে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী প্রথম নির্মাণ
যুগের পরবর্তী আমলে এ পুকুর খনন করা হয়
এবং এসময় এ অংশের সিঁড়িটি ধ্বংস
করে দেয়া হয়।
পরবর্তীকালে পুকুরটি ভরাট
করে দেয়া হয়।
বিহারের অন্তর্বর্তী স্থানের উন্মুক্ত
চত্বরের
মধ্যবর্তী স্থানে রয়েছে কেন্দ্রীয়
মন্দিরের ধ্বংশাবশেষ। এখন
এটি ২১মি উঁচু হলেও মূল
মন্দিরটি কমপক্ষে ৩০ মি উঁচু ছিল।
তিনটি ক্রমহ্রাসমান
ধাপে ঊর্ধ্বগামী এ মন্দিরের ভূমি-
পরিকল্পনা ক্রুশাকার।
প্রতিটি ক্রুশবাহুর দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ১০৮.৩
মি ও ৯৫.৪৫মি। কুশের
মধ্যবর্তী স্থানে আরও
কয়েকটি অতিরিক্ত দেয়াল
কৌণিকভাবে যুক্ত। মূল পরিকল্পনাটির
কেন্দ্রে দরজা-জানালা বিহীন
একটি শূন্যগর্ভ চতুষ্কোণাকার প্রকোষ্ঠ
আছে। এই প্রকোষ্ঠটি মন্দিরের তলদেশ
থেকে চূড়া পর্যন্ত বিস্তৃত। মূলতঃ এ
শূন্যগর্ভ প্রকোষ্ঠটিকে কেন্দ্র করেই
সুবিশাল এ মন্দিরের
কাঠামো নির্মিত। এ কক্ষের
চারদিকে মন্দিরের দ্বিতীয়
ধাপে চারটি কক্ষ ও মন্ডপ নির্মাণ
করা হয়েছে। এর ফলেই
মন্দিরটি ক্রুশাকার ধারণ করেছে।
মন্দির পরিকল্পনার
সমান্তরালে দেয়াল পরিবেষ্টিত
প্রদক্ষিণ পথ আছে। অনুরুপভাবে প্রথম
ধাপে দ্বিতীয় ধাপের প্রদক্ষিণ পথের
দেয়ালের চারদিকে চারটি কক্ষ যুক্ত
করে ক্রুশাকৃতি বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ
রাখা হয়েছে এবং এর
সমান্তরালে প্রদক্ষিণ পথ নির্মাণ
করা হয়েছে। প্রথম ধাপের
সমান্তরালে মন্দিরের ভিত্তিভূমির
পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে দেয়াল
তৈরি করা হয়েছে। উত্তর দিকের
মধ্যবর্তীস্থলে সিঁড়ি ছিল।
পরবর্তিতে এ সিঁড়ি ধ্বংস করে তার
উপর কিছু নতুন কাঠামো নির্মাণ
করা হয়।
কেন্দ্রীয় শূন্যগর্ভ কক্ষে একটি ইঁট
বাধানো মেঝে আবিষ্কৃত হয়েছে। এ
মেঝে কক্ষের বাইরে চারদিকের কক্ষ ও
মন্ডপের প্রায় একই সমতলে অবস্তথিত।
কিন্তু চারদিকের
কক্ষগুলো থেকে কেন্দ্রীয় এ
কক্ষে যাওয়ার কোন পথ বা দরজা নেই
এবং আগে ছিলো,পরে বন্ধ
করা হয়েছে এমন কোন প্রমাণও
পাওয়া যায় না। কক্ষে মূর্তি রাখার
বেদী বা কুলুঙ্গী কিছুই নেই। তাই
অনুমিত হয় ফাঁপা এ দন্ডটি মন্দিরের
সুউচ্চ দেয়ালগুলোর সুদৃঢ় নির্মানের জন্য
একটি উপকরণ ছিল। মূর্তিগুলো সম্ভবত এর
চারদিকের কক্ষগুলোতে স্থাপন
করা হয়েছিলো। মন্দিরের শীর্ষদেশের
কোন নিদর্শন নেই বিধায় এর ছাদ
সম্বন্ধে সুস্পষ্ট কিছু বলা যায় না।
কেন্দ্রীয় শূন্যগর্ভ কক্ষটির দেয়াল
নিরাভরণ কিন্তু প্রতিটি ধাপের
দেয়ালগুলোর বহির্ভাগ উদগত কার্নিশ,
অলংকৃত ইঁট এবং সারিবদ্ধ পোড়ামাটির
ফলকচিত্র দ্বারা সজ্জিত। ক্রুশাকার
পরিকল্পনার বর্ধিত অংশগুলোর
সংযোগস্থলে কার্নিশের প্রান্ত পর্যন্ত
পানি নিষ্কাশন নালার ব্যবস্থা আছে।
পাথর নির্মিত এ নালাগুলোর মুখ
গর্জনরত সিংহের মুখের
অবয়বে নির্মিত। ভিত্তিভূমির
দেয়ালের
বহির্দেশে ৬৩টি কুলুঙ্গি আছে। এর
প্রতিটিতে একটি করে পাথরের
ভাস্কর্য ছিলো।
বিহারের মধ্যবর্তী উন্মুক্ত অঙ্গনে আরও
কিছু ইমারতের ধ্বংসাবশেষ
পাওয়া যায়। এদের মাঝে বেশ কিছু
ইমারতের বৈশিষ্ট্য সনাক্ত করা সম্ভব
হয়নি। অঙ্গনের দক্ষিণ-
পূর্বাংশে ভোজনশালা ও
রন্ধনশালা অবস্থিত। এ দুটি স্থাপনার
মাঝে ৪৬মি দীর্ঘ ইট
বাঁধানো একটি নর্দমা আছে এবং এর
কাছে এক সারিতে তিনটি কূপ আছে।
এছাড়াও রয়েছে কিছু নিবেদন স্তূপ,
প্রশাসনিক ভবন, কেন্দ্রীয় মন্দিরের
প্রতিকৃতি ইত্যাদি। নিবেদন স্তূপগুলোর
মাঝে দক্ষিণ-পূর্বাংশে অবস্থিত
স্তূপটি ১৬কোণ বিশিষ্ট নক্ষত্র আকৃতির।
অনুচ্চ একটি মঞ্চের মাঝে সংস্থাপিত
এ স্তূপটির সংলগ্ন
স্থানে রয়েছে একটি পাকা কূপ।
অন্যান্য নিবেদন
স্তূপগুলো বিক্ষিপ্তভাবে নির্মিত।
চত্বরের উত্তর-পূর্বাংশের
ইমারতগুলো সম্ভবত প্রশাসনিক
এবং অন্যান্য কাজে ব্যবহৃত হত।
তথ্যের জন্য উইকিপিডিয়ার
কাছে কৃতজ্ঞতা রইলো।
শুক্রবার, ২১ মার্চ, ২০১৪
ইতিহাস!
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন